টেকসই নগরায়ন ও পরিকল্পিত ছাদকৃষি

টেকসই নগরায়ন ও পরিকল্পিত ছাদকৃষি

দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ শহরে বসবাস করে এবং শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগে উন্নীত হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই নগর নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সবুজ পরিবেশ, যা বিশুদ্ধ বাতাস ও জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন হবে এবং স্থানীয় খাদ্য চাহিদা যথাসম্ভব স্থানীয় উত্পাদনের মাধ্যমে মেটানো যাবে। জনসংখ্যার আধিক্য ও ভূমি স্বল্পতার বাংলাদেশে নগরগুলোতে কি সমতল ভূমিতে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন সম্ভব? শহরের সুস্থ পরিবেশের জন্য সুপারিশকৃত শতকরা ২৫ ভাগ ভূমি গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত করার মতো পর্যাপ্ত খালি জায়গা নেই; রাজধানী ঢাকার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, পুরান ঢাকায় সবুজ ভূমি মাত্র ৫ শতাংশ ও নতুন ঢাকায় তা মাত্র ১২ শতাংশ। বর্ধিষ্ণু এই নগরের টেকসই নগরায়ণ তাহলে কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহর এমনকি জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠছে অসংখ্য বিল্ডিং; শুধু ঢাকা শহরেই চার লক্ষাধিক বিল্ডিং রয়েছেযেখানে প্রায় দশ হাজার হেক্টর খালি ছাদ আছে। কংক্রিটের সমতল ছাদগুলো হতে পারে বিশুদ্ধ বাতাস ও নিরাপদ সতেজ শাকসবজি ও ফলমূলের আধার; ছাদগুলো পরিকল্পিত সবুজায়নের মাধ্যমে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট’ (শহর ও নিকটবর্তী শহরতলির তাপমাত্রার পার্থক্য) কমিয়ে আনা সম্ভব এবং ছাদে স্থাপিত বাগানসমূহের উত্পাদিত কৃষিপণ্য শহরের খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করবে

যদিও দেশে ছাদবাগান চর্চা হচ্ছে, কিন্তু বিদ্যমান সম্ভাবনার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। ছাদবাগান থেকে উত্পাদিত পণ্যে নিজস্ব চাহিদা মেটানোতে সম্পূরক হিসেবে ও সামাজিক আদান-প্রদানে ব্যবহূত হচ্ছে অর্থাত্ ছাদবাগান কার্যক্রম এখনো শখের স্তরে আছে। সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব গাছের পরিবর্তে অনেকে ছাদে চাষের অনুপযোগী গাছ লাগিয়ে জায়গার অপচয় করছেন, বাস্তবে পরিবেশগত বা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হচ্ছে না। বাংলাদেশে ছাদবাগান স্থাপনে প্রণোদনার ঘাটতি রয়েছে; দেশের প্রচলিত বিল্ডিং কোড বা অন্য কোনো বিধি-বিধান দ্বারা বিল্ডিংয়ের ছাদে গাছপালা দিয়ে সবুজায়নের ব্যাপারে বিল্ডিং মালিকদের প্রতি কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। বিল্ডিংয়ের একাধিক মালিকানা ছাদবাগান স্থাপনের অন্তরায়, সেজন্য অনেক ছাদে কোনো ফ্ল্যাট মালিক চাইলেও বাগান করতে পারেন না, ছাদ খালি পড়ে থাকে। ফ্ল্যাট মালিকদের বিরোধের কারণে কখনো কখনো প্রতিষ্ঠিত ছাদবাগান দুঃখজনকভাবে কেটে ফেলতে দেখা যায়। ভবন মালিকগণ কখনো কখনো ভাড়াটিয়াদের ছাদে প্রবেশাধিকার বা বাগান করার সুযোগ দেন না; সেজন্য কোনো ভাড়াটিয়ার ইচ্ছা থাকলেও ছাদবাগান করতে পারেন না। ঢাকা শহরে ছাদবাগান স্থাপনে বাধাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ছাদবাগান স্থাপনের আইনগত ভিত্তি, মানসম্মত বীজ ও চারার দুষ্প্রাপ্যতা, মাটি, কম্পোস্ট ও গোবর, বাগানে ব্যবহূত যন্ত্রসামগ্রীর অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব এবং প্রযুক্তিগত তথ্য এবং পরামর্শের ঘাটতি

ছাদবাগানের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন শুধু বিল্ডিং ও ফ্ল্যাটের মালিকের ওপর নির্ভর করে না, সরকারের গৃহীত নীতি ও বিধি-বিধান ছাদবাগান সম্প্রসারণে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টরেন্টো সিটি কাউন্সিল ২০০৯ সালে ‘গ্রিন রুফ’ নামে একটি পরিপূর্ণ উপ-আইন প্রণয়ন করে যেখানে গ্রিন রুফ নির্মাণ স্ট্যান্ডার্ড, প্রযুক্তিগত পরামর্শ টিম, অপরাধ ও জরিমানাসহ পরিপূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া আছে। এই আইন অনুযায়ী নতুন আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিল্ডিংসমূহের ছাদে অবশ্যই একটি অংশ গাছ দিয়ে সবুজায়ন করতে হবে। জাপানেও এরকম বাধ্যবাধকতা রয়েছে; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন’ নামক বাণিজ্যিক বিল্ডিংয়ের জন্য রেটিং সিস্টেম চালু করেছে যেখানে বিল্ডিং স্থাপনের কারণে পরিবেশ ও সবুজের বিনষ্ট হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিল্ডিংয়ের ছাদে সবুজায়ন ও রেইন ওয়াটার হার্ভেস্ট সিস্টেম রাখার বিধান রয়েছে। সাংহাই, চায়নাতে হাই-টেক নগর কৃষির মাধ্যমে উত্পাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। সিঙ্গাপুর সুউচ্চ ভবনগুলিতে স্কাই ফার্মিং মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শাকসবজির চাহিদা মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে; এমনকি, নগর কৃষি ও সবুজায়ন নিশ্চিত করতে সে দেশ ‘আরবান রি-ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ নামে সরকারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছে

সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঢাকা শহরে নগরকৃষি সহায়ক একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেছে যার মাধ্যমে পরিকল্পিত লাভজনক ছাদবাগান স্থাপনে নগরবাসীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন ছাদবাগানিদের হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর মৌখিক ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় কৃষি নীতি, ২০১৮ অনুযায়ী ছাদবাগানকে মূল কৃষিধারায় অন্তর্ভুক্ত করা ও বাণিজ্যিকীকরণে সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাদকৃষির কাঙ্ক্ষিত সম্ভাবনার সুফল পেতে হলে নগরকৃষিকে নগর পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তকরণ, স্বতন্ত্র নগরকৃষি বা ছাদকৃষি নীতিমালা প্রণয়ন, ছাদবাগান স্থাপন ও সুরক্ষায় আইনি বাধ্যবাধকতা প্রর্বতন করলে লাভজনক ও বাণিজ্যিক ছাদকৃষির আইনগত ভিত্তি স্থাপিত হবে। ছাদবাগানিদের উত্পাদিত ফল, শাকসবজি বিপণনের সুবিধা ও উপকরণপ্রাপ্তিতে নগরীর সুপার শপগুলোতে ‘ছাদকৃষি কর্নার’ স্থাপন করা যেতে পারে। নগরকৃষিকে বেগবান করতে সিটি করপোরেশনসমূহে নগরকৃষি বিভাগ চালু করা যায়; প্রয়োজনে নগরীর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান যেমন রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ‘নগর সবুজায়ন কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ধারণের অন্যতম উপাদান বিশুদ্ধ বাতাস, গাছপালায় আচ্ছাদিত পাখপাখালির কলরবে সবুজে মোড়ানো, আধুনিকতা ও প্রকৃতির মিশেলে মনোরম টেকসই নাগরিক জীবন, পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগে স্থাপিত ছাদবাগানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে

নগরায়ন ও পরিকল্পিত ছাদকৃষি

লেখক: অতিরিক্ত উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা